বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাতি । এই অভিযোগ দীর্ঘ দিনের । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা দীনেশচন্দ্র সেন, অনেকের লেখনীতেই এই আক্ষেপ উঠে এসেছে, বিভিন্ন সময়ে। গত কয়েক দশকে, ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক পরিচালিত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায়, বাঙালীর সাফল্য ব্যর্থতার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করতে গেলে, যেন সেই অভিযোগের প্রাসঙ্গিকতাই ঘুরেফিরে সামনে চলে আসে ।

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা যা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস নামে পরিচিত ছিল, প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষা হিসাবে প্রথম শুরু হয় ১৮৫৫ সালে। ১৮৬৩ সালে, শুধু একজন বাঙালী নয়, প্রথম ভারতীয় হিসাবে ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায়  সাফল্য অর্জন করেন , সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপর প্রায় এক শতক, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বাঙালীর সাফল্যের হার ছিল ঈর্ষণীয় । এর পরবর্তী সামাজিক-অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালীর সিভিল সার্ভিস বিমুখতা নিয়ে, বহু তর্ক-বিতর্কই  সাম্প্রতিক অতীতে হয়েছে । তাই সেই আলোচনায় আর না গিয়ে, চেষ্টা থাকবে, বর্তমান সময়ে যে সমস্ত পরীক্ষার্থী বাংলা থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বা নেওয়ার কথা ভাবছেন, তাদের কিছু জিজ্ঞাসা বা কৌতুহলের নিরসন ঘটাবার ।

দিল্লী চলো –  সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি যে সমস্ত পরীক্ষার্থী নিচ্ছেন, তাদের কাছে এ যেন এক জাদু মন্ত্র, সে তিনি যে রাজ্যেরই হন না কেনো । প্রতি বছর বিহার, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান বা দক্ষিণের রাজ্য গুলি থেকে বহু পরীক্ষার্থী এসে উপস্থিত হন দিল্লীর রাজেন্দ্রনগর, কারোলবাগ, মুখার্জীনগর বা পার্শ্ববর্তী এলাকায়। তুলনায় অনেকটাই কম বাংলা থেকে দিল্লী, পারি দেওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, প্রায় হাতে গোনা বললেই চলে। এই অল্প কয়েক জন কে বাদ দিলে বাকিদের মনে বা কথা বার্তায় কিন্তু দিল্লীর প্রসঙ্গ উঠে আসে বারে বারে  – সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফলতার জন্য কি দিল্লী যাওয়া অনিবার্য ! এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় না দিয়ে, চেষ্টা করবো দিল্লী যাত্রার ভালো মন্দ দুই দিকই  তুলে ধরার । একটা বিষয় কখনোই অস্বীকার করা যায়না যে দিল্লীতে প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু বাড়তি সুবিধা অবশ্যই  আছে । প্রথমেই বলতে হয়  – বিভিন্ন রাজ্যের বহু সংখ্যক পরীক্ষার্থী একসাথে মুখার্জীনগর  বা রাজেন্দ্রনগর এ জড়ো হওয়ায় যে প্রতিযোগিতা মূলক পরিবেশে তৈরি হয় তা দেশের অন্য কোথাও পাওয়া সম্ভব নয় । কোচিং সেন্টার  এবং বইপত্র বা অন্যান্য নোটস এর সহজ লভ্যতা তো আছেই ।  চায়ের দোকান থেকে শুরু করে লাইব্রেরী বা  ফোটোকপি সেন্টার, সবই যেন ছোট ছোট গ্রুপ স্টাডির জায়গা হয়ে ওঠে ।

কিন্তু ‘চকচক করিলেই যেমন সোনা হয় না’ ঠিক তেমনি দিল্লির ঝাঁ, চকচকে কর্পোরেট স্টাইলের কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলেই যে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফলতা আসবেই তা নয়।। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা যেমন স্বাভাবিক , তেমনই নামিদামি প্রতিষ্ঠানেরা, টিউশন ফী বাবদ যে মূল্য দাবি করে, তা অনেক সময়ই থেকে যায় মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। তাছাড়া এই বহু সংখ্যক কোচিং সেন্টার, স্টাডি ম্যাটেরিয়ালস আর বইপত্তরের ভিড়ে, পরীক্ষার্থীরা অনেক সময়ই খেই হারিয়ে ফেলেন, সমস্যায় পড়েন একটি নির্দিষ্ট দিশায় প্রস্তুতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে I তাই দিল্লী যাওয়ার ব্যাপারে যারা ভাবনা চিন্তা করছেন, তাদের জন্য পরামর্শ থাকবে তথাকথিত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যারা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন, তাদের সম্বন্ধে একবার বিশদে খোঁজ নিন, পারলে যারা আগে দিল্লীতে থেকে এই বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, সেরকম কোনো পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে জেনে নিন কোচিং সেন্টার গুলির সম্বন্ধে , বা ইন্টারনেট এর সাহায্য নিয়ে, বিভিন্ন ব্লগ, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চেষ্টা করুন এই প্রতিষ্ঠান গুলির ভালো-মন্দ দুই দিকই বিচার করার| কেবলমাত্র সাফল্যের সংখ্যা বা বিজ্ঞাপনের উপর ভিত্তি করে কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বেছে না নেওয়াই বাঞ্ছনীয় – স্কোরবোর্ড সব সময় সত্যি কথা বলেন। আর দিল্লী যাওয়ার আগে অবশ্যই কিছু পড়াশোনা করে রাখুন, যাতে কোচিং সেন্টারের ক্লাসের সাথে তাল মেলাতে সুবিধা হয়।

এখন ছাত্রছাত্রীদের মনে এই প্রশ্ন আশা স্বাভাবিক যে তাহলে ‘দিল্লী চলো’র বিকল্প কী! এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে আপনি যদি দিল্লী যেতে না চান, তাহলে দিল্লীই হাজির হবে আপনার পড়ার টেবিলে – নামী বা অনামী, সব কোচিং সেন্টারই আজ তাদের অনলাইন ক্লাস নিয়ে উপস্থিত আপনার, কম্পিউটার – ল্যাপটপ বা ট্যাবলেটের পর্দায়। দুই, কোচিং নির্ভর প্রস্তুতির মধ্যে না গিয়ে, ‘সেলফ স্টাডি’র মধ্যে দিয়ে নিজেকে তৈরি করা। যদি সমমনস্ক দুই-তিন জন মিলে ‘গ্রুপ স্টাডি’র মাধ্যমে প্রস্তুতি নেওয়া যায়, তাহলে কোচিং এর প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমে আসে। আর সম্প্রতি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাজ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সিভিল সার্ভিস স্টাডি সেন্টার (সংক্ষেপে এস.এন.টি.সি.এস.এস.সি) – রয়েছে প্রিলিমিস, মেইন্স, পার্সোনালটি টেস্ট – তিনটি স্তরেই প্রশিক্ষণের সু-ব্যবস্থা। এস.এন.টি.সি.এস.এস.সির মাধ্যমে শুধু কলকাতাতেই নয়, প্রত্যেকটি জেলাতেও, যে সমস্ত পরীক্ষার্থী সিভিল সার্ভিস এর প্রস্তুতি নিতে চান তাদের কে বেছে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু এস.এন.টি.সি.এস.এস.সি, যেহেতু একটি প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের বাছাই করে থাকে, তাই দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে ধারণা এবং সাধারণ জ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ এক্ষেত্রেও  জরুরি।

প্রস্তুতি সংক্রান্ত আর যে সমস্ত প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, তার মধ্যে সববচেয়ে বেশি কানে আসে – ” বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে কী সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব”! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমার দুটি সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে – আমরা যারা আদ্যোপান্ত বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছি, তারা অনেক সময় কিছুটা হিনমন্যতায় ভুগি, অথবা মনে করি ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে-মেয়েরা বোধহয় সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলির ক্ষেত্রে আমাদের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা কী বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন, সে আলোচনার পরিসর এখানে নেই – কিন্তু একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়, যে কেবলমাত্র বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনার জন্য, কেও যদি মনে করেন, তিনি অন্যদের থেকে পিছিয়ে আছেন বা তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার অযোগ্য, তাহলে সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। সাম্প্রতিক অতীতে যারা বাংলা থেকে সাফল্য অর্জন করেছেন, তারা সকলে না হলেও, অনেকেই কিন্তু পড়াশোনা করেছেন বাংলা মাধ্যমে । তবে একথাও বলতে দ্বিধা নেই, যে অধিকাংশ বই, ম্যাগাজিন বা স্টাডি মেটেরিয়াল ইংরেজিতেই উপলব্ধ হওয়ায়, প্রস্তুতির প্রথম দিকে বিভিন্ন পরিভাষা নিয়ে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু অভাস্যের সাথে সাথে বিষয়বস্তুর উপর দখল চলে এলে ভাষাগত সমস্যা অনেকটাই মিটে যায়। আর কেও যদি ইংরেজিতে একেবারেই স্বাছন্দ্য বোধ না করেন, তাহলে অবশ্যই  তিনি বাংলা মাধ্যমেই সবকটি বিষয়ের পরীক্ষা দিতে পারেন। শুধুমাত্র বাংলা নয়, অষ্টম তফসিল অন্তর্ভুক্ত যে কোনো ভাষাকে আপনি মূল পরীক্ষার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিতে পারেন। একই নিয়ম প্রযোজ্য সাক্ষাৎকার বা পার্সোনালিটি টেস্ট এর ক্ষেত্রেও। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বহু পরীক্ষার্থী নিজের মাতৃভাষাতেই পরীক্ষা দিয়ে সফলতা অর্জন করেন।

এছাড়াও বেশ কিছু প্রশ্ন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি সংক্রান্ত যে কোনো আলোচনাতেই উঠে আসে, যেমন স্নাতক স্তরে কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করলে, প্রস্তুতিতে সুবিধা হবে বা, কোন ঐচ্ছিক বিষয়টি বেশি নাম্বার পেতে সাহায্য করবে। বিগত বেশ কয়েক বছরে যারা সাফল্য অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে যেমন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন, তেমনই কলা বা বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক এরকম ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাও কম নয়। ঠিক একই ভাবে বলা যায়, ঐচ্ছিক হিসাবে বেশ কয়েকটি বিষয় যেমন ইতিহাস, ভূগোল বা সমাজ বিজ্ঞান, পরীক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও, কোনো একটি যে অতিরিক্ত নম্বর এনে দেবে এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই। এরকম ছোট ছোট অনেক জিজ্ঞাসাই পরীক্ষার্থীদের ভাবিয়ে তোলে, তাই নিজেদের  মধ্যে নিয়মিত আলোচনা বা গ্রুপস্টাডি অনেক ক্ষেত্রেই বেশ কার্যকরী হয়ে ওঠে।

শেষ করতে গিয়েও আবার সেই শুরুতেই ফিরে আসি। আমরা আত্মবিস্মৃত জাতি। সেই বিস্মৃতিতে আমরা মনে করতে পারিনা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রমেশচন্দ্র দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বা সুভাষচন্দ্র বসুকে। আমরা ভুলে যাই ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন বা স্বাধীন ভারতে কর্মরত শেষ আই.সি.এস অফিসার, যিনি ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসাবে আমলাতন্ত্রের শীর্ষ স্থান অধিকার করেছিলেন সেই নির্মল কুমার মুখার্জীকে।নিজেদের আত্মবিশ্বাসে  ভরসা রাখতে না পেরে একটাই প্রশ্ন যেনো বারবার ঘুরে ফিরে আসে – আমরা কি পারবো!! উত্তর খোঁজার ভার আমি না হয়, পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্ত ছাত্রছাত্রী, আই.এ.এস বা আই.পি.এস হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, তাদের উপরেই ছাড়লাম।

কলমে – সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য্য, আই.পি.এস
মতামত ব্যক্তিগত

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা ও বাঙালি পরীক্ষার্থীদের সাফল্য ব্যর্থতা – বাংলা, বাঙালি ও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা

Categories: Uncategorized

1 Comment

Gouranga Pakhira · June 19, 2023 at 2:21 pm

হ্যাঁ স্যার নিজের সবটা দেওয়ার চেষ্টা করবো… একদিন দেখা করবো আপনাদের সাথে ( Ansar Shaikh Sir ,Jitin Yadav sir , Elma Afroz madam and you .)

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *